আজ যখন এই লেখাটি লিখছি, দেশে তখন হরতাল চলছে। বিএনপি দু’দিনের হরতাল ডেকেছে। সে হিসাবে আগামীকালও হরতাল। কোন দল হরতাল ডাকলে সেটা হলো কি হলো না, তা মাপার কোন বাটখারা নেই। রাস্তায় গাড়ি কতগুলো চললো, দোকানপাট কতগুলো খুললো সে হিসাব রাজনৈতিক দলগুলো করে। সরকারী দল রাস্তা ভর্তি যানবাহন দেখতে পায়, দাবি করে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক, হরতাল হয়নি। আর বিরোধীদল রাস্তায় কোনই যানবাহন দেখতে পায় না, তাদের দাবি স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল হয়েছে।
কাজেই হরতাল হচ্ছে কি হয়নি, হরতাল মানুষ চায় কি চায় না, হরতাল দেয়া ছাড়া বিরোধীদলের সামনে আর কোন উপায় ছিল কি ছিল না-এসব অন্তহীন বিতর্কে আমি যাবো না। যে কারণে এই হরতাল, অর্থাৎ গায়েব হয়ে যাওয়া ইলিয়াস আলীকে নিয়ে আমি কিছু কথা বলতে চাই।আজ প্রায় দু’সপ্তাহ হ’তে চললো, ইলিয়াস আলী হারিয়ে গেছেন। গাড়ি নিয়ে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন, বাসায় আর ফিরে আসেন নি। গাড়ি রাস্তায় পড়ে রয়েছে, উধাও হয়ে গেছেন ইলিয়াস আলী আর তার গাড়িচালক। রহস্যজনক এই অন্তর্ধান নিয়ে এ যাবত কথাবার্তা কম হয়নি। বিরোধী দল শুরু থেকেই এ জন্য সরকারকে দায়ী করে আসছে। বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, র্যাব দিয়ে সরকার তাকে উঠিয়ে নিয়ে গুম করে দিয়েছে। আর এর বিপরীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দলীয় নেত্রীর পরামর্শেই আন্দোলনের পরিবেশ তৈরি করে দিতে ইলিয়াস আলী লুকিয়ে আছেন।
এর বাইরেও কিছু কথাবার্তা আছে। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, এ ঘটনায় সরকার নাকি খুবই বিব্রত। এই ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার কখনো দেখা হয়নি, তাকে যতটুকু দেখেছি টেলিভিশনের পর্দাতেই। টেলিভিশন আর পত্রপত্রিকায় তার যেসব কথাবার্তা শুনি, তার আলোকে আমার মনে একটা সন্দেহ তৈরি হয়েছে। এই যে ‘সরকার বিব্রত’- এ কথাটি তিনি ঠিক বুঝে বলেছেন তো? মানুষ কখন বিব্রত হয়? যখন কিছু অপকর্ম করে ধরা পড়ে যায়, তখনই তো, নাকি?
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, তারা প্রাণান্তকর চেষ্টা করছেন ইলিয়াস আলীকে খুঁজে পেতে। তবে সাগর-রুনি’র হত্যাকারীদের ৪৮ ঘন্টার মধ্যে খুঁজে বের করার হুঙ্কারের শেষ পরিণতি দেখার পর এই ভদ্রমহিলার কথার আর কোন গুরুত্ব সাধারণ মানুষের কাছে আছে কিনা আমার জানা নেই।
আর সরকারের সবচেয়ে সরব মন্ত্রী হিসাবে পরিচিত আইন প্রতিমন্ত্রী নিজেই আবার পাল্টা প্রশ্ন করে বসলেন, ইলিয়াস আলীকে সরকার কেন গুম করবে? আচ্ছা ভদ্রলোক এই প্রশ্নটি কাকে করলেন? জনগনকে, বিরোধীদলকে, নাকি নিজেদেরকেই?
সরকারী দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে আমার কাছে তুলনামূলকভাবে সংযত ও ধীরস্থির টাইপের মানুষ মনে হয়। তিনি বললেন, তিনি নাকি বিশ্বাস করেন যে ইলিয়াস আলী জীবিত আছেন, এবং সুস্থভাবেই ফিরে আসবেন।
আসলে সৈয়দ আশরাফ উচ্চারিত এই সম্ভাবনার যৌক্তিকতা নিয়েই আমার আজকের এই লেখা। ধরে নিলাম, ইলিয়াস আলী সুস্থ আছেন, এবং তিনি সুস্থভাবেই ফিরে আসবেন। কিন্তু তিনি কিভাবে আসবেন? বোবা হয়ে আসবেন, নাকি এসে সরব হবেন? স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে আসবেন, নাকি ফিরে এসে মাঝের এই দিনগুলোর প্রতিটি মুহূর্তের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিতে পারবেন? নাকি যা ঘটেনি, তারও বিশ্বাসযোগ্য বর্ণনা দিতে শুরু করবেন?
এতসব প্রশ্নের মধ্যে, সবচেয়ে জরুরি কিন্তু প্রথমটি। কিভাবে ফিরে আসবেন তিনি? তার গায়েব হয়ে যাওয়ার পেছনে যে কারণ অথবা সম্ভাবনাগুলো থাকতে পারে, সেগুলোর দিকে বরং একবার তাকানো যাক।
গায়েবের সম্ভাব্য কারণ, এক: ইলিয়াস আলী তার নেত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী আন্দোলনের ইস্যু তৈরির জন্য নিজে থেকেই লুকিয়ে আছেন। দেশের প্রধানমন্ত্রী নিজেই এই কারণটিকে বিশ্বাস করেন। ধরে নিলাম এটাই সত্য। তাহলে, লুকিয়ে থাকা ইলিয়াস আলী এখন কী করবেন? তিনি কি তার নেত্রীর পরবর্তী পরামর্শের অপেক্ষায় আছেন? বেগম খালেদা জিয়া যখনই বলবেন, বের হয়ে আসবেন তিনি? কিন্তু সেটা কিভাবে সম্ভব? বের হয়ে এসে কী বলবেন তিনি? বলবেন, নেত্রীর নির্দেশেই গা-ঢাকা দিয়ে ছিলেন এতদিন? তাহলে কি বিএনপি’র আর কোন রাজনীতি থাকে?
গায়েবের সম্ভাব্য কারণ, দুই: র্যাব অথবা অন্য কোন বাহিনী দিয়ে ইলিয়াস আলীকে সরকার তুলে নিয়ে গেছে। বেগম খালেদা জিয়া এবং বিএনপি’র নেতারা বলেছেন এই কথা। এটি যদি সত্য হয়, তাহলে ইলিয়াস আলী ফিরে আসবেন কিভাবে? যারা তুলে নিয়ে গেছে তারা যদি তাকে ছেড়ে দেয়, কেবল তাহলেই তার ফিরে আসা সম্ভব। কিন্তু তা কি তারা করবেন? কোন ভরসায় করবেন? মুক্ত ইলিয়াস যখন মুখ খুলবেন, তখন কোথায় যেয়ে নামবে সরকারের ভাবমূর্তি? সরকার কি সেই ঝুঁকি নেবে?
গায়েবের সম্ভাব্য কারণ, তিন: নেত্রীর পরামর্শে নয়, সরকারের বিশেষ বাহিনীর মাধ্যমেও নয়, ইলিয়াস আলী নিজ দায়িত্বেই লুকিয়ে আছেন। শুরুতে হয়তো ভেবেছিলেন, হারিয়ে যাওয়া নিয়ে তার এলাকায় হৈচৈ হবে, তার জনপ্রিয়তা বাড়বে, তারপর একসময় সুবিধামত সময়ে বের হয়ে আসবেন। তর্কের খাতিরে এটাকে যদি সত্য বলে ধরে নিই, তাহলেও কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, কিভাবে নিজের লুকানো জায়গা থেকে বের হয়ে আসবেন তিনি? বের হয়ে এসে কি ব্যাখ্যা দেবেন নিজের এ কয়দিনের অবস্থান সম্পর্কে? সরকারের উপর দায় চাপাবেন? কিন্তু সেটা কি প্রমাণ করা সম্ভব হবে? যদি প্রমাণ করতে না পারেন, তাহলে নিজের রাজনীতির আর কি কিছু অবশিষ্ট থাকবে?
গায়েবের সম্ভাব্য কারণ, চার: তার কোন ব্যক্তিগত প্রতিদ্বন্দ্বীর কাজ এটা, তারা-ই অপহরণ করিয়েছে ইলিয়াস আলীকে? সেক্ষেত্রে একটা প্রশ্ন কিন্তু থাকছেই, সেরকম কিছু হলে গাড়িচালকসহ অপহরণ করা হবে কেন? তারপরও যদি ধরে নেয়া যায়, এরকমই কিছু একটা হয়েছে, সে ক্ষেত্রেও কিন্তু ইলিয়াসের ফিরে আসা যথেষ্ট জটিল। পরিস্থিতি ইতোমধ্যে এতটা জট পাকিয়ে গেছে, অপহারণকারীরা এখন যদি চায়ও যে তারা ইলিয়াসকে ছেড়ে দেবে, সেটাও সম্ভব হবে না। তখন তাদের নিজেদের জীবন নিয়েই টানাটানি শুরু হয়ে যাবে।
গায়েবের সম্ভাব্য আরও বেশ কিছু কারণের কথা হয়তো বলা যেতে পারে। কিন্তু প্রতিটা ক্ষেত্রে সমস্যা ওই একটাই, সমাধানের কোন সহজ কোন পথ নেই। শুরুতে হয়তো কোন পথ ছিল, কিন্তু দিন যতই যাচ্ছে সে পথ ততই জটিল হতে হতে অসম্ভবের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
ইলিয়াস আলী’র এই হারিয়ে যাওয়াকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনীতির মাঠেও হয়তো নানা সমীকরণ এখন চলছে। হচ্ছে লাভ-ক্ষতির হিসাব। এক পক্ষের লাভ হবে, আর এক পক্ষের ক্ষতি, কারও জন্য হয়তো আবির্ভূত হবে বুমেরাং হিসাবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা হয়তো চুলচেরা হিসাব করে লাভ-ক্ষতির সে পরিমাণ বেরও করে ফেলতে পারবেন। কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা, কী চলছে এখন ইলিয়াস আলী’র স্ত্রী-সন্তান-পরিবারের জীবনে?
রাজনৈতিক বিচারে ইলিয়াস আলী একজন পরিচিত লোক। কিন্তু তাকে আমি চিনতাম না, এমনকি তার সম্পর্কে তেমন কোন ধারণাও আমার ছিল না। গত কয়েকদিনে তাকে নিয়ে যখন হৈচৈ শুরু হলো, তখন তার সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করলাম। বিভিন্ন লেখালেখি থেকে যে চিত্র পেলাম, তাতে জাতীয় রাজনীতিতে তাকে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ কোন ব্যক্তিত্ব বলেও মনে হয়নি। তার অতীত রাজনৈতিক পথ পরিক্রমাও যে খুব একটা নিষ্কলঙ্ক ছিল, সেটাও হয়তো বলা যাবে না।
কিন্তু তারপরও স্ত্রী’র কাছে, সন্তানের কাছে তার অবস্থান সকল প্রশ্নের উর্ধ্বে। স্বামীর অনিশ্চিত এই অবস্থান নিয়ে লুনা’র মনে এখন কী চলছে, তা কি আমরা কখনো বুঝতে পারবো? এই ভদ্রমহিলাকে এখন যদি তার স্বামীর মুক্তির জন্য অনেকগুলো শর্ত দেয়া হয়, আমি নিশ্চিত চোখ বুজে তার সবগুলোই তিনি মেনে নেবেন। রাজনীতির চেয়েও তার কাছে কয়েক হাজার গুণ বড় তার সংসার, তার স্বামীর জীবন। এমন রাজনীতি আমরা কেন করবো, যা মানুষের সংসারকে তছনছ করে দেয়, যা একজন নারীর, তার অবুঝ সন্তানদের রাতের ঘুম কেড়ে নেয়?